তৈয়বুর রহমান কিশোর, বোয়ালমারী প্রতিনিধি: তামাক পোড়ানোর ঘরে যখন আগুন দেয় তখন আমরা কেউ ঘরে থাকতে পারিনা। প্রচন্ড ধেঁায়া আর তামাকের গন্ধে দম বন্ধ হয়ে আসে।

দিনের বেলায় বাড়িতে থাকা কঠিন আবার রাতের বেলায় ঘুমাতে পারিনা। ওদের বললেও ওরা কোন কথা শোনেনা। একেবারে আবাসিক এলাকার মধ্যে দুই দুটি তামাক পোড়ানোর ঘর।

এর মধ্যে অনেকেই অসুস্থ হয়ে পড়েছে। নিরুপায় হয়ে পরিবেশ অধিদপ্তরসহ বিভিন্ন দপ্তরে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহনের জন্য লিখিত অভিযোগ দিয়েছি। এ কথাগুলো বলছিলেন ফরিদপুরের বোয়ালমারী উপজেলার পরমেশ্বরদী গ্রামের ফকিরপাড়ার মো. সুরুজ আকন। সুরুজের স্ত্রী বলেন, ধেঁায়ায় বাড়িঘর অন্ধকার হয়ে যায়। বাড়িতে থাকতে না পেরে আমার শাশুড়ি কুলসুম বেগম (৮০) অন্য বাড়িতে গিয়ে থাকে। আমার মেয়েটার বাচ্চাকাচ্চা হবে, তাকে এখানে এনে রেখেছিলাম কিন্তু সে অসুস্থ হয়ে পড়ায় তাকে শশুর বাড়ি পাঠিয়ে দিয়েছি। ফরিদপুরের বোয়ালমারীতে হঠাৎ করে বেড়ে গেছে তামাকের চাষ।

উপজেলার চতুল, পরমেশ্বরদী এবং রূপাপাত ইউনিয়নে সর্বাধিক তামাকের চাষ হয়ে থাকে। অন্যান্য ইউনিয়নেও থাকতে পাওে তামাকের চাষ। উপজেলা কৃষি অফিস সূত্র জানায় উপজেলার প্রায় ৪০ পাখি জমিতে তামাক চাষ হয়। তবে বাস্তবে এর পরিমান আরও বেশি হবে বলে সূধীজনের ধারনা।

মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ২০১৬ সালে লক্ষ্যমাত্রা ঠিক করেছিলেন যে ২০৪০ সালের মধ্যে দেশকে তামাকমুক্ত করা হবে। সেখানে দিনে দিনে তামাকের চাষ বৃদ্ধি পাওয়ায় প্রধানমন্ত্রীর লক্ষ্যমাত্র হুমকির মুখে। তামাক কোম্পানিগুলো নানা প্রলোভনে সাধারন মানুষকে তামাক চাষে প্রলুব্ধ করছে।

আর কোন প্রকার নিরাপত্তা ব্যবস্থা গ্রহণ ছাড়াই মানুষ কাজ করছে তামাক চাষ থেকে শুরু কওে প্রক্রিয়াকরণ পর্যন্থ। কোন কাগজপত্র ছাড়াই আবাসিক এলাকায় চলছে তামাক প্রক্রিয়াজাত করণ। তামাক প্রক্রিয়া করণের ফলে অসুস্থ হচ্ছে মানুষ।

দূষিত হচ্ছে পরিবেশ। দীর্ঘ মেয়াদী স্বাস্থ্য ঝঁুকিতে পড়ছে সাধারন মানুষ। এ জন্য আবাসিক এলাকায় বিষাক্ত তামাক প্রক্রিয়াকরণ বন্ধ করার জন্য গত ৩০ মার্চ ফরিবেশ অধিদপ্তরসহ বিভিন্ন যায়গায় লিখিত আবেদন করেছেন পরমেশ্বরদী গ্রামের ফকিরপাড়ার মো. সুরুজ আকন। সরেজমিনে পরমেশ্বরদীর ফকির পাড়া গিয়ে দেখা যায়, সুরুজ আকনের ঘরের পাশেই কঁাচা তামাক পাতা প্রক্রিয়াকরণের (পোড়ানোর) একটি ঘর বানিয়েছে আশরাফ ফকিরের ছেলে শাহানুর ফকির।

এ ঘরকে টোবাকো বার্ন হাউজ বা রকেট বার্ন বলা হয়। বাইরে থেকে সেখানে আগুন দিচ্ছে শাহানুর ফকিরের মেয়ে আছমা বেগম। ঘর সমান উচু একটি পাইপ দিয়ে ধেঁায়া উঠে ছড়িয়ে পড়ছে আবাসিক এলাকায়। শাহানুরের বাড়ির পাশে আরও একটি তামাক পোড়ানোর ঘর। শাহানুর ফকির বলেন, আরও আগে থেকে চতুল ইউনিয়নের হাসামদিয়াসহ বিভিন্ন এলাকায় তামাক চাষ হয়ে আসছে। সেখানে কোন সমস্যা হচ্ছেনা, সব সমস্যা আমাদের এখানে ? তিনি আরও জানান গত দুই বছর যাবত তারা তামাক চাষ শুরু করেছে। তার মেয়ে আছমার বিয়ে দিয়েছে কুষ্টিয়ায়। সেই জামাই তাদেরকে তামাক চাষে উদ্বুদ্ধ করেছে।

শাহানুর ফকির এবার চার একরের বেশি জমিতে তামাক চাষ করেছে। শাহানুরের জামাই কুষ্টিয়ার দৌলতপুর উপজেলার রিফায়েতপুর গ্রামের গিয়াসউদ্দীনের ছেলে আনোয়ার হোসেন বলেন, আমরা এলাকায় তামাক চাষ করেই চলি। বেশি অর্থের আশায় এখানেও তামাক চাষ শুরু করেছি।

পরমেশ্বরদী মাঠে ৭ পাখি (৩০ শতাংশে এক পাখি) জমিতে তামাক চাষ করছি। একটি টোবাকো কোম্পানীর ফিল্ডম্যান জুয়েল রানার মাধ্যমে চুক্তি করে তামাক চাষ করা হয়। কোম্পানী অগ্রীম টাকা দেয়, সার দেয়, তামাক পোড়ানোর ঘর করার জন্য টাকা দেয়। তামাক শুকিয়ে প্রক্রিয়া করার পর তারা বাড়িতে এসে তামাক কিনে নিয়ে যায়।

প্রতি কেজি তামাকের মূল্য ধরা হয় ১৬৭ টাকা করে। তামাক কেনার সময় আগের দেওয়া সকল অর্থ এডজাস্ট করা হয়। তাদের তামাক পোড়ানোর ঘরের জন্য পরিবেশ অধিদপ্তর বা মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তরের কোন অনুমোদন আছে কি না, জানতে চাইলে বলেন কোন অনুমোদন নেই। কোন ট্রেড লাইসেন্সও নেই। গ্রামের কালাম আকন জানান, একটু সমস্য আছে কিন্তু টাকা পাওয়া যায় বেশি। আমি শুধু তামাক চাষের জন্য ৭ পাখি জমি বর্গা দিয়েছি। প্রতি পাখি দশ হাজার টাকা করে।

তামাক উঠে গেলে আবার অন্য ফসল বোনাবো। শাহানুরের স্ত্রী রিনা বেগম বলেন, ধেঁায়া, গন্ধ্যে আমদের কিছু হয়না। অন্য এলাকায় তামাক চাষ আছে সেখানে কেউতো অসুস্থ হয়নি। এ ব্যাপারে ব্রিটিশ আমেরিকা টোবাকো কোম্পানীর ফিল্ড টেকনিশিয়ান মো. জুয়েল রানা বলেন, তামাক চাষের জন্য চাষীদের সাথে চুক্তি করা হয়। তাদেরকে ক্যাশ সাপোর্টসহ সার, কীটনাশক দেওয়া হয়। বার্ন হাউজ বানানোর জন্য নগদ ৮ হাজার টাকা দেওয়া হয়। তিনি বলেন, ধূয়া উঠার চিমনি উচু হলে কোন সমস্য হয়না। তবে শাহানুরের ঘরের চিমনিটা একটু ছোট হয়েছে।

উপজেলা কৃষি কর্মকর্তা কৃষিবিদ প্রীতম কুমার হোড় বলেন, তামাক চাষে সরকারের কোন নিষেধাজ্ঞা নেই। তারপরও আমরা তামাক চাষ নিরুৎসাহিত করে থাকি। সম্প্রতি বোয়ালমারীতে আশংকাজনকহারে বেড়েছে তামাক চাষ। আমাদের হিসাব মতে বর্তমানে উপজেলায় প্রায় ৪০ পাখি জমিতে তামাক চাষ হয়। তামাক চাষের ফলে রবি শস্য যেমন রাই. শরিষা, মসুর, ছোলা চাষ কমে যাচ্ছে। এ রকম হলে মানুষের পুষ্টির সমস্যা দেখা দিবে।

উপজেলা স্বাস্থ্য ও পরিবার পরিকল্পনা কর্মকর্তা ডা. খালেদুর রহমান বলেন, তামাক একটি বিষাক্ত জিনিস। যা মাদক হিসেবে চিহ্নিত। তামাক; চাষ থেকে শুরু করে প্রক্রিয়াকরণ এবং প্রক্রিয়াকরণ এলাকার আশপাশের লোকজন শ্বাসকষ্টসহ নানা ধরনের রোগে আক্রান্ত হতে পারে। সিগারেটের যে ক্ষতি তামাকেও সেই একই ক্ষতি। এর থেকে দীর্ঘমেয়াদী এজমা, ক্যন্সারসহ অনেক রোগ হতে পারে। ফুসফুস নষ্ট হতে পারে। অতি দ্রুত আবাসিক এলাকায় তামাক প্রক্রিয়াকরণ কাজ বন্ধ করা এবং তামাক চাষ বন্ধ করা উচিৎ বলে মনে করেন ডা. খালেদুর রহমান।

উপজেলা নির্বাহী অফিসার মো. রেজাউল করিম বলেন, আবাসিক এলাকায় এভাবে তামাক পোড়ালেতো পরিবেশের সমস্যা। তিনি তাৎক্ষনিকভাবে বিষয়টি পরিবেশ অধিদপ্তরকে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহনের অনুরোধ জানান।